রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবং সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা ও নিরীক্ষা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনে বেশ কয়েকদফা প্রকল্প নেয়া হলেও খুব একটা কাজে আসেনি। কিন্তু এসব প্রকল্প কেন উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারল না? তার কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের পথ অবলম্বন ছাড়াই আবারো বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটি বলছে, পুরোনো প্রকল্পের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াই দাতাসংস্থার প্রেসক্রিপশনের অন্ধ অনুসরণে নতুন প্রকল্প নেয়া অপরিণামদর্শী ও সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ হবে বলে একইসাথে আয়কর আদায় সহজ ও করফাঁকি রোধে আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশজ প্রযুক্তি-সক্ষমতা ও সম্ভাবনার ওপর সর্বোচ্চ প্রাধান্যের আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) পাঠানো এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলছে, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আয়কর আদায় বাড়াতে ও করফাঁকি রোধে রাজস্ব বোর্ড বিশ্বব্যাংকের সহায়তায়, প্রায় এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা করছে। যদিও বিগত দেড় দশকে রাজস্ব আদায়-প্রক্রিয়া ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়াতে অন্তত তিনটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রাজস্ব বিভাগ, যার কোনো বাস্তব সুফল অর্জিত হয়নি।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এসব প্রকল্প যে উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি, তার বড় প্রমাণ, নতুন করে বিশ্বব্যাংকের ঋণনির্ভর হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের প্রয়াস। কারণ আয়কর রিটার্ন দাখিল বা ভ্যাট আদায়-প্রক্রিয়া এখনো অনলাইন করা যায়নি। কাগুজে পদ্ধতিই এখনো রাজস্ব আদায়ের বড় ভরসা। হয়রানি ও দুর্নীতি কমেনি। চালান জালিয়াতি নিয়ন্ত্রিত হয়নি, করফাঁকি আর অর্থপাচার নিয়ন্ত্রিত হয়নি। দেশের কর জিডিপির অনুপাতও বাড়েনি বরং কমে গেছে এক যুগে। অর্থবছর ২০২৪-এ তা নেমে এসেছে ৮.৫-এ, ঠিক একযুগ আগে যা ৯.১ শতাংশ ছিল। আর এক যুগের গড় অনুপাত হিসাব করলে, যা আরো কম ৭.৪ শতাংশ। যেটি পুরো বিশ্বে সবচেয়ে কম কর জিডিপির অনুপাতের দেশের একটিতে পরিণত করেছে। এমন বাস্তবতায় বছরের পর বছর ধরে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো কেন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে? এর পেছনের কারণ বিশেষ করে এর কতোটা রাজস্ব বিভাগের ভেতরে থাকা দুর্নীতির দুষ্ট চক্রের হাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জিম্মিদশা। কিংবা যথাযথ দেশজ প্রযুক্তি-সক্ষমতা ও সম্ভাবনার সুফল আদায়ে অনীহাসহ করনীতির ধারাবাহিকতার ঘাটতির ফসল, তার অনুসন্ধান জরুরি।’
ড. জামান বলেন, ‘আয়কর ব্যবস্থাপনা-প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, পরিসংখ্যান ব্যবস্থার উন্নয়ন, সরকারি ক্রয় ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরীক্ষা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়নের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রণীত স্ট্রেনদেনিং ইন্সটিটিউশনস ফর ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি (সিটা) নামের পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ কোটি মার্কিন ডলার। এ প্রকল্পের একটি বড় অংশই ব্যয় হবে সরকারি আয় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনার অটোমেশন কার্যক্রমে।’
প্রযুক্তি-নির্ভর এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আয়কর আদায় ব্যবস্থাপনা অটোমেশন করার জন্য ঠিকাদার যে সফটওয়্যার সরবরাহ করে তা শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়নি। বরং পরে দেশেই স্বল্প ব্যয়ে আরেকটি ই-রিটার্ন ফাইলিং ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। একইভাবে অন্য প্রকল্পে সহায়তার শর্ত মেনে ভেন্ডর লকড বা কমার্শিয়াল অফ-দ্য-সেলফ (কটস) সফটওয়্যার কিনে, ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাওয়ার উদাহরণও আছে। এমন বাস্তবতায় নতুন প্রকল্প গ্রহণে দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশনের অন্ধ অনুসরণ নয় বরং বাস্তবতা মেনে সহজ ব্যবহার ও টেকসই সক্ষমতার ব্যবস্থাপনার কথা মাথায় রেখে প্রযুক্তি বাছাই করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান দেশজ প্রযুক্তি-সক্ষমতা ও সম্ভাবনার সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিজের কারিগরি অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টি সতর্কভাবে বিবেচনা করতে হবে।’
প্রকল্পের আওতায় ‘এসএপি’ প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র তৈরির সুযোগ রাখার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে ড. জামান বলেন, ‘সাধারণত প্রযুক্তি বা সফটওয়্যার যারা সরবরাহ করেন তারাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় লোকবলের প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়নের কাজ করে। সেখানে কোন বিবেচনায়? কার স্বার্থে? ধার করা টাকায় এমন একটি বিশেষায়িত সেন্টার গড়ে তোলার সুযোগ রাখা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগকে দীর্ঘমেয়াদে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রপ্রাইটরি সফটওয়্যার ব্যবহারে জিম্মি করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে কি-না, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। যোগ্যতা ও সম্ভাবনা থাকা সাপেক্ষে দেশজ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকেও এ ধরনের কাজে যুক্ত করার বিষয়টি উন্মুক্ত রাখার ওপর সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে।’