নির্বাচনের পথে আরো কয়েকটি ইস্যু রয়েছে যেগুলোর সমাধান নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষক
মফঃস্বল বার্তা প্রতিবেদন: আমি, আমজনতা বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, তাদের মনোভাব ও সেন্টিমেন্ট জানার চেষ্টা করেছি। বিভিন্নভাবে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের পালস স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। এসবে আমার ধারণা হয়েছে যে তারা এখন পর্যন্ত ড. ইউনূস, তার উপদেষ্টা পরিষদ এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অগ্রনায়ক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দের ওপর খুবই সন্তুষ্ট। পক্ষান্তরে একটি শ্রেণী প্রায় মাস দেড়েক ধরে এই সরকারের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত। আমি গভীর দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে কোনো কোনো মহল যত দ্রুত সম্ভব সাধারণ নির্বাচনের জন্য পেরেশান হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ঢাকা এবং মফস্বলের আমজনতার মধ্যে ইলেকশন নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। শেখ হাসিনার মতো একজন দানবী এবং তার দানব সরকারের কবল থেকে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ গত ৫ আগস্ট মুক্তি পেয়েছেন, এতেই তারা খুশি। রিক্সাওয়ালা বা ভ্যানগাড়ি ওয়ালাদের কেউ কেউ আমার কাছে এমন মন্তব্যও করেছেন যে তারা অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ হাবিয়া দোজখ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এতেই তারা খুশি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিগত সাড়ে তিন মাসে যা দেখলাম, মনে হয় স্বল্পভাষী। বিগত সাড়ে তিন মাসে তিনি জাতির উদ্দেশে ৩ টি ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি তিনি অনেক কথা বলেছেন। এরমধ্যে রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত টিভি চ্যানেল আল জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দান, ভারতের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দি হিন্দুকে ইন্টারভিউ দেওয়া, দেশের মধ্যে ইংরেজি ডেইলি স্টারকে ইন্টারভিউ দেওয়া এবং বাংলা দৈনিক বণিক বার্তাকে ইন্টারভিউ দেওয়া। এতদিন তিনি তার ভেতরের প্ল্যান, যদি কিছু থেকে থাকে, প্রকাশ করেননি। কিন্তু আলোচ্য এই চারটি ইন্টারভিউয়ে তিনি যা বলেছেন সেখান থেকে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। সেটি হলো, সংস্কার, নির্বাচন এবং সংবিধান সম্পর্কে। আমি কোনো দল বিশেষের নাম উল্লেখ করতে চাই না। কিন্তু কোনো কোনো বড় দলের বড় বড় নেতা এমনও বলেছেন যে এই সরকার কি ২০ বছর থাকতে চায় নাকি? আবার অন্যেরা বলেছেন, তারা ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। আলোচ্য চারটি ইন্টারভিউয়ে ড. ইউনূস মোটামুটি যা বলেছেন সেখান থেকে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মোটামুটি সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন নয়।
আল জাজিরাকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে ড. ইউনূস যা বলেছিলেন, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর গণমাধ্যমে সেটি সঠিকভাবে পরিবেশন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আল জাজিরার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে ড. ইউনূসের সরকার ৪ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। অথচ এই ৪ বছরের ব্যাপারে ড. ইউনূস যা বলেছেন সেটি তার সরকারের মেয়াদ সম্পর্কিত নয়। ভাল করে পড়লে দেখা যাবে যে ৪ বছরের কথাটি তিনি বলেছেন আগামী দিনের যে নির্বাচিত পার্লামেন্ট আসছে সেটার মেয়াদ ৪ বছর হতে পারে। এই ৪ বছরও ড. ইউনূসের নিজস্ব মতামত নয়। তিনি বলেছেন যে উন্নত বিশে^র কোনো কোনো দেশে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ ৪ বছর। মেয়াদ যদি ৪ বছর হয় তাহলে সেই সরকার সব সময়ই জনগণের চাপের মধ্যে থাকে। এই চাপের মধ্যে থাকার ফলে তাদেরকে স্বল্প সময়ে দ্রুত গতিতে বেশি করে জনকল্যাণমূলক কাজ করতে হয়। দৈনিক বণিক বার্তা তার কাছে এই চার বছরের কথা তুললে তিনি তো স্পষ্ট বলেন যে এই চার বছরের কথা তো আমি বলেছি ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের মেয়াদ সম্পর্কে। এব্যাপারে নিতি স্পষ্ট বলেন যে তার সরকারের মেয়াদ আর যাই হোক, ৪ বছরের কম হবে। তারপর তিনি বলেন, এর চেয়েও কম হতে পারে। তবে কত কম হবে তিনি সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না।
॥ দুই ॥
এব্যাপারে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে তিনি কোনো বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেবেন না। এমনকি ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের মেয়াদ সম্পর্কে যে চার বছরের কথা তিনি বলেছেন সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত মত। এই মতও তিনি কারো ওপর চাপিয়ে দেবেন না। তিনি বলেছেন, এরমধ্যে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ৬টি কমিশন ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। এসব কমিশনের মধ্যে রয়েছে, নির্বাচন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। বাঁকি যে চারটি কমিশন গঠন করা হয়েছে তাদের কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কারণ তাদের বসার মতো ঘর বাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। আর দুই চারদিনের মধ্যেই তাদের অফিস ঠিক করা এবং সেই অফিস সাজানোর কাজ কমপ্লিট হবে।
আরেকটি বিষয় ড. ইউনূস বলেছেন যা তিনি বিগত সাড়ে তিন মাসে বলেননি। যে চারটি ইন্টারভিউয়ের কথা উল্লেখ করেছি ঐগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিতে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আপনি কি রিফর্ম বা সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে চান? উত্তরে তিনি বলেন, তিনি কিছুই করতে চান না।
ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভব না হলেও জানুয়ারির মধ্যে কমিশনগুলো তাদের খসড়া রিপোর্ট দেবে। তিনি সেগুলো রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক আলোচনা করবেন। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় সেটি হলো, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ঐকমত্য। তিনি বলেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। যেগুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না সেগুলোতে তিনি হাত দেবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো যা ভাল বোঝে তাই করবে।
তিনি এও বলেন যে ১০ টি কমিশনের কোনো কমিশনের কোনো প্রস্তাবেও যদি ঐকমত্য না হয় তাহলে তিনি সেই অবস্থাতেই রেখে দেবেন এবং সাথে সাথেই নির্বাচন দেবেন। রাজনৈতিক দলগুলো তাকে এখন বলুক যে সংস্কার তারাই করবে। এটি তো অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের সংস্কার করার দরকার নেই। একথা বললে এই মুহূর্তেই তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলবেন। গত ২০ নবেম্বর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন যে দুই এক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায় এই কলাম লিখতে গিয়ে দেখলাম, অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আরও চার কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিশনার হিসেবে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তাহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
ড. ইউনূসের কথার সূত্র ধরে বলা যায় যে নির্বাচন কবে হবে সেটি তো তিনি বলবেন না। তিনি অথবা তার সরকার যে নির্বাচন নিয়ে অনাবশ্যকভাবে বিলম্ব করবেন তাও নয়। কারণ নির্বাচনের সমস্ত খুঁটিনাটি সম্পন্ন করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন চাইলেই তো ২/৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে পারবেন না। কারণ নির্বাচন কমিশনের সর্ব প্রধান দায়িত্ব হবে ভোটার লিস্ট হালনাগাদ করা। সকলেই এই বিষয়ে একমত যে শেখ হাসিনার আমলে যে তিনবার ভোট হয়েছে (২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪) সেগুলো কোনো নির্বাচন ছিল না। ওগুলো ছিল সব প্রতারণা, ধোঁকাবাজি এবং ভোট ডাকাতি। নির্বাচনের কোনো সংজ্ঞাতেই ওগুলো পড়ে না। নির্বাচনের নাম করে শেখ হাসিনা এই তিনটি মেয়াদে যে সরকার গঠন করেছেন এবং চালিয়েছেন সেগুলো সব অবৈধ। এই তিনটি নির্বাচনের মেয়াদে, অর্থাৎ বিগত ১৫ বছরে প্রচুর নতুন ভোটার হয়েছেন। ২০১৪ সালে যার বয়স ছিল ৮ বছর তার বয়স এখন ১৮ বছর। ড. ইউনূসসহ অনেক আদমশুমারী বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার অন্তত ৫০ শতাংশ হলো তরুণ ও যুবক। এদের অধিকাংশই বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এদের সকলকে এবার ভোটার লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি একটি বিরাট কাজ।
তিন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন যে মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার কমিশনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনই শুধু নয়, সেই নির্বাচনে সকল ভোটার যাতে ভোট দিতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য নতুন নির্বাচন কশিনের সাথে তাদের বসতে হবে।
ড. ইউনূস বণিক বার্তাকে বলেছেন যে তার উপদেষ্টা পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই দ্রুত দায়িত্বভার ছেড়ে দিতে চান। কারণ তারা যা বেতন পান সে টাকা দিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খরচসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ড. ইউনূসের আমলে ২৪ জন উপদেষ্টার মধ্যে একজনের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত ঘুষ বা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু ঐসব উপদেষ্টার ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য পেশা আছে যেখান থেকে তাদের যে হালাল রুজি হয় সেটি তাদের সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট। এখন উপদেষ্টার কাজ করতে গিয়ে তারা তাদের পেশা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
চার নির্বাচনের পথে আরো কয়েকটি ইস্যু রয়েছে যেগুলোর সমাধান নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। এগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং অন্যেরা দৃঢ়তার সাথে বলছেন যে খুনী এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বিএনপি বলছে, তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। বিএনপির এই উক্তিতে মানুষ তাজ্জব হয়ে যান। বিএনপির এই উক্তি জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, এটি বুঝতে পেরে মির্জা ফখরুল এখন বলেছেন যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। জনগণ কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবে? জনগণের সিদ্ধান্ত জানতে হলে তো গণভোট লাগবে। বিএনপি কি এই প্রশ্নে গণভোট করতে চায়?
এই প্রশ্ন এবং আরো কয়েকটি জ্বলন্ত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে রচনা। সেখানে রাষ্ট্রের মূলনীতি, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো নির্ধারণ ইত্যাদি। পরবর্তীতে সেগুলো আলোচনার ইচ্ছা রইল।