ভারতের একমাত্র মুসলিম-গরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতিও ঘোষণা করেছেন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জারি থাকবে এবং আইনটি বাতিল না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন থামবে না।
ভারতে যে রাজ্যটিতে মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেটি হল উত্তরপ্রদেশ। প্রায় চার কোটি মুসলিমের বসবাস এই রাজ্যে, গোটা দেশের মধ্যে ওয়াকফ সম্পত্তিও এখানেই সবচেয়ে বেশি।
তবে উত্তরপ্রদেশ রাজস্ব দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী রাজ্যে নথিভুক্ত ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা মাত্র ২৯৬৩। কিন্তু এর বাইরেও রাজ্যে আরও প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো ওয়াকফ সম্পত্তি আছে, সরকারের কাছে যার কোনও রেকর্ড নেই।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, এর অধিকাংশ জোর করে দখল করে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, এমনটা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে!
ভারতের দ্য ডেকান হেরাল্ড পত্রিকা জানাচ্ছে, ওয়াকফ বোর্ডের হাত থেকে এই সম্পত্তিগুলোর দখল ফিরে পেতে রাজস্ব দফতর গোটা রাজ্য জুড়ে সার্ভে চালানো শুরু করেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই।
প্রতিটি জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের তাদের জেলায় ‘বেআইনিভাবে ওয়াকফ ঘোষণা করা’ সম্পত্তিগুলো চিহ্নিত করার নির্দেশও পাঠানো হয়েছে।
আর নতুন ওয়াকফ আইন পাস হওয়ার পর দিনই রাজ্যের যোগী আদিত্যনাথ সরকার ঘোষণা করেছে, রাজ্যের সমস্ত ‘বেআইনি’ ওয়াকফ সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে নিজেদের দখলে নেবে।
এখানে বিশেষভাবে নিশানা করা হচ্ছে বরাবাঁকি, সীতাপুর, বেরিলি, সাহারানপুর, বিজনোর, মুজফফরনগর, মোরাদাবাদ ও রামপুরের মতো মুসলিম-অধ্যুষিত জেলাগুলো – যেখানে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে যে কোনও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও যে কঠোর হাতে দমন করা হবে, রাজ্য সরকার সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে।
মুজফফরাবাদের কাছে সারওয়াত গ্রামে জুম্মার নামাজের সময় কালো আর্মব্যান্ড পরে এই আইনের প্রতিবাদ জানানোর ‘অপরাধে’ পুলিশ তিনশোরও বেশি গ্রামবাসীকে ২ লক্ষ রুপি করে জরিমানার নোটিশ পাঠিয়েছে।
গ্রামের আয়েশা মসজিদের ইমাম মৌলানা শিবলী দ্য হিন্দু পত্রিকাকে জানিয়েছেন, তাদের প্রতিবাদ ছিল সম্পূর্ণ প্রতীকী ও শান্তিপূর্ণ – “কেউ একটা মৃদু স্লোগান পর্যন্ত দেয়নি – তারপরও এই গরিব মানুষগুলোকে শান্তিভঙ্গ করার অভিযোগে অযথা হেনস্থা করা হচ্ছে!”
পুরো এলাকার পরিবেশ এখনও থমথমে হয়ে আছে – টুঁ শব্দ করলে বুলডোজার পাঠিয়ে প্রশাসন বাড়ি-ঘর-দোকান ভেঙে দিতে পারে, এই ভয়ে গ্রামবাসীরা সিঁটিয়ে আছেন বলে জানিয়েছে দ্য হিন্দু।
উত্তরপ্রদেশের পরই ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ওয়াকফ সম্পত্তি আছে পশ্চিমবঙ্গে, আর সেখানেও নতুন আইনটির বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চলছে।
এদিনও (১০ জুলাই) কলকাতার রামলীলা ময়দানে জমিয়ত-ই-উলেমা হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে এই আইনটি বাতিল করার দাবিতে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সংখ্যালঘু খ্রীষ্টান ও শিখ সমাচেে প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে জমিয়তের নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বলেন, “২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ১১৫৯টি আইন বাতিল করেছে। ঠিকমতো চাপ দিলে তারা ওয়াকফ আইনও বাতিল করতে বাধ্য হবে।”
সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট আসনের তৃণমূল বিধায়কও।
তিনি অভিযোগ করেন, দেশের শাসক বিজেপি ও তাদের অভিভাবক আরএসএস পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় মুসলিমদের নিশানা করতেই এই আইনটি এনেছে।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় এই আইনের বিরুদ্ধে দফায় দফায় বিক্ষোভ ও সহিংসতা হয়েছে, জঙ্গীপুর-সহ একধিক এলাকা চরম অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে।
জমিয়তের সভা থেকে অবশ্য মুসলিমদের সহিংসতা পরিহার করে আইনটির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালানোর ডাক দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন তিনি তার রাজ্যে নতুন আইনটি প্রয়োগ হতে দেবেন না এবং কেন্দ্রে সরকার বদল হলে এই আইনটিও বাতিল হয়ে যাবে বলে আশা করছেন।
নতুন ওয়াকফ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বুধবার (৯ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন তৃণমূলের কৃষ্ণনগরের এমপি মহুয়া মৈত্র।
মিস মৈত্র তার আবেদনে বলেছেন, এই আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে শুধু যে পদ্ধতিগত ত্রুটি হয়েছে তাই নয় – সংবিধানে আধারিত নাগরিকদের একাধিক মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে।
তিনি দাবি করেছেন, যে যৌথ সংসদীয় কমিটি এই বিলটি যাচাই-বাছাই করেছিল তার চেয়ারপার্সন চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় কমিটির বিরোধী সদস্যদের আপত্তিমূলক পর্যবেক্ষণগুলো ছেঁটে ফেলেছিলেন।
নতুন আইনটি ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল ১৪ (আইনের চোখে সমতা), ১৫(১) (বৈষম্যহীনতা), ১৯(১) ও সি (মতপ্রকাশের স্বাধীনতা), ২১ (জীবনের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা), ২৫ ও ২৬ (ধর্মীয় স্বাধীনতা), ২৯ ও ৩০ (ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার) এবং আর্টিকল ৩০০এ-র (সম্পত্তির অধিকার)সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও তিনি পিটিশনে উল্লেখ করেছেন।
এর মধ্যে এই আইনটির বিরুদ্ধে আরও মোট দশটি পিটিশন শীর্ষ আদালতে জমা পড়েছে, সেই আবেদনকারীদের মধ্যে এআইএমআইএম নেতা ও হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং সম্ভালের সমাজবাদী পার্টি এমপি জিয়া-উর রহমান বার্কও আছেন।
এখন এই পিটিশনগুলো একত্র করে তা শুনবেন দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ।
প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও জাস্টিস সঞ্জয় কুমার ও জাস্টিস কে ভি বিশ্বনাথনকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চের এজলাসে আগামী ১৬ এপ্রিল (বুধবার) এটির শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য কোনও আইনকে সরাসরি বাতিল করতে পারে না – তবে তারা যদি কোনও আইনকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় তাহলে সরকার কার্যত সেটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
ফলে ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতের রায়ের দিকেই এখন তাকিয়ে আছেন প্রতিবাদকারীরা।