• ৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সরকারি সেবায় আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?

Mofossal Barta
প্রকাশিত মে ১৪, ২০২৫, ২১:৩৮ অপরাহ্ণ
সরকারি সেবায় আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?

এস্তোনিয়া নামের ইউরোপের ছোট্ট দেশটি ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর প্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে তারা ১৯৯৭ সালেই শুরু করে অনলাইনে সরকারি সেবা দেওয়া। এরপর ২০০২ সালের মধ্যে দেশটি তার সব স্কুলে ইন্টারনেট চালু করে। শুধু তা-ই নয়, ২০১২ সালের মধ্যে তাদের ৯০ শতাংশ সরকারি কাজ চলে যায় অনলাইনে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

কৌশিক আহমেদ: দুই দশক আগেও বাংলাদেশে সরকারি সেবা মানেই ছিল কাগজপত্রের পাহাড়, ফাইলের পেছনে দৌড়ঝাঁপ আর দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। কিন্তু কতটা বদলেছে? সরকারি সেবায় উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে আমাদের অবস্থান কোথায় এবং আমাদের কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

এস্তোনিয়া নামের ইউরোপের ছোট্ট দেশটি ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর প্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে তারা ১৯৯৭ সালেই শুরু করে অনলাইনে সরকারি সেবা দেওয়া। এরপর ২০০২ সালের মধ্যে দেশটি তার সব স্কুলে ইন্টারনেট চালু করে। শুধু তা-ই নয়, ২০১২ সালের মধ্যে তাদের ৯০ শতাংশ সরকারি কাজ চলে যায় অনলাইনে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন ছিল ‘এক্স-রোড’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো নিরাপদে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। নাগরিকেরা ঘরে বসেই কর প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, এমনকি ভোট দেওয়ার মতো কাজ করতে পারেন। তারা প্রথম দেশ হিসেবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি সরকারি ব্যবস্থায় ব্যবহার করে এবং ‘ই-রেসিডেন্সি’ চালু করে যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো ব্যক্তি-নাগরিকত্ব ছাড়াই-এস্তোনিয়ার ডিজিটাল সেবা, যেমন ব্যবসা নিবন্ধন, ট্যাক্স ফাইলিং এবং ই-সিগনেচার ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।

সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয় ১৯৬৫ সালে। তখন তারা ছিল অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর। আশির দশকে তারা তথ্যপ্রযুক্তিকে সামনে রেখে উন্নয়নের পরিকল্পনা করে। ১৯৯৯ সালে চালু করে ‘ইসিটিজেন’ নামের ওয়ানস্টপ পোর্টাল, যেখানে এক প্ল্যাটফর্ম থেকেই নাগরিকেরা সরকারি সব সেবা পেতে পারেন। শুধু অবকাঠামো নয়, তারা সাধারণ মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে সেকেন্ড হ্যান্ড কম্পিউটার বিতরণ করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকারি কর্মচারীদের। তাদের এই উদ্যোগগুলো আজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।

বাংলাদেশ: পথচলা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্সের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে। সেই ধারাবাহিকতায় ‘মাইগভ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যেখানে নাগরিকেরা এক জায়গা থেকেই বিভিন্ন সরকারি সেবা পাচ্ছেন। কোভিডের সময় ১৩ কোটির বেশি মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ ছিল একটি বড় সফলতা। এখন টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল শিক্ষা, ই-ফাইলিং, ওনলাইন ট্রেড লাইসেন্স, এমনকি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনও করা যাচ্ছে অনলাইনে।

তবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জও কম নয়। এস্তোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ আর প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৪০ জন। বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি, আর ঘনত্ব ৩৫০০ জনের কাছাকাছি। সিঙ্গাপুর দ্বীপ রাষ্ট্র, ছোট আয়তনে ইন্টারনেট অবকাঠামো গড়তে সুবিধা হয়েছে। আমাদের দেশ আয়তনে বড়, লোকসংখ্যাও বেশি-ফলে চাহিদা আর বাস্তবায়নে ব্যবধান থাকবেই। যদিও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) এর নেতৃত্বে চালু হচ্ছে আরও নতুন উদ্যোগ।

সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শেখা, চোখ বন্ধ করে অনুকরণ নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব বাস্তবতা বুঝে, বিশ্বের ভালো উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।

এ জন্য দরকার-পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। আর সবচেয়ে জরুরি-সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। কারণ প্রযুক্তিনির্ভর সেবা যদি সবাই ব্যবহার না করতে পারে, তাহলে সেটি কোনো কাজে আসবে না।

এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুর আমাদের জন্য তুলনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু অনুকরণীয় নয়। আমরা যদি নিজেদের মতো করে শিখে উদ্ভাবন করি এবং নিজেদের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে উদ্ভাবন করি তবে একদিন পিছিয়ে থাকা বিশ্বের অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের পথ অনুসরণ করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই দুই দশক আমাদের শিখিয়েছে-সঠিক দিশায় চললে, অগ্রগতি সম্ভব। এখন সময় সেই পথচলাকে আরও সুসংগঠিত, মানবিক আর অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলার।