তৌহিদুল ইসলাম, ব্যুরো প্রধান, বরিশাল বিভাগ :
রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ রক্ষায় মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় ১৩ অক্টোবর (রবিবার) থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বিক্রয় ও পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অপরদিকে, সাগরে বার বার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এবছর জেলেরা আশানুরূপ মাছ শিকার করতে পারেননি। নতুন করে মাছ ধরা বন্ধের ঘোষণায় উপকূলের জেলেদের মাঝে হতাশা ও উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে।
ভূক্তভোগী ফিশিংবোট মালিক ও জেলেরা জানান, গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে তারা ৯-১০বার বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছেন। উত্তাল সাগরে মাছ ধরতে না পেরে খালি ট্রলার নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়ায় তারা বিপুল আর্থিক লোকসানে পড়েছেন ।
পাথরঘাটা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি চৌধুরী গোলাম মোস্তফা বলেন, সাগরে মাছ ধরতে একেকটি ট্রলারের পিছনে তিন-চার লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এবছর সাগরের আবহাওয়া নয়-দশ দফা খারাপ হওয়ায় জেলেরা মাছ ধরতে পারেনি। ফলে বিপুল পরিমাণ লোকসান হওয়ায় জেলে মহাজনদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। প্রতি বছর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়েই জেলেরা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পরে বর্তমানে আবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বেকার জেলেদের মাঝে হতাশা ও উৎকন্ঠার পাশাপাশি মানবতার জীবন যাপনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে আরো জানান, নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার জেলেরা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মূখীন হয়েছেন। মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে তিনি ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা কমিয়ে এনে ভারতের সাথে মিল রেখে একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
বরগুনার ট্রলার মালিকরা বলেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে তাদের ফিশিংবোট নয়-দশ বার সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ায় মাছ ধরতে না পারায় প্রতিবারই তাদের লোকসান হয়েছে। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় দেশীয় জেলেরা মাছ ধরতে না পারলেও পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা ঠিকই মাছ ধরে নিয়ে যায়।
জানাযায়, এ বছরে একাধিকবার বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে দুর্যোগের কবলে পড়ে এ পর্যন্ত সাগরে ঠিকমতো জাল ফেলতে না পারায় কাঙ্ক্ষিত ইলিশ আহরণ করতে পারেননি জেলেরা। ফলে অধিকাংশ ট্রলার মালিক, আড়ৎদার ও ব্যবসায়ীরা রয়েছেন লোকসানে। এদিকে চলমান ২২ দিনের অবরোধ বরগুনার জেলেরা মেনে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকলেও নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাবে বলে অভিযোগ করেন জেলে ও ট্রলার মালিকরা।
বরগুনার মৎস্য অফিসের হিসাব অনুযায়ী বরগুনায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৪৬ হাজার। বেসরকারি হিসেবে জেলেদের সংখ্যা লক্ষাধিক। তবে বিভিন্ন সময়ের নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৬ হাজার জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া চাল বিতরণেও রয়েছে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ।
এফবি রাফি’র মাঝি রতন বলেন, নিষেধাজ্ঞা শুনে যখন ফিরছিলাম তখনই দেখলাম শত শত ভারতীয় ট্রলার মাছ ধরছে। এরকম প্রতি বছর তারা বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এভাবে তারা ধরে থাকে তাহলে তো আমরা কোনো বছরই মাছ পাব না। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই ভারতীয় জেলেরা আমাদের জলসীমায় যেন প্রবেশ না করে।
জেলেরা বলেন, বাংলাদেশে নদ-নদীসহ বঙ্গোপসাগরে ২২ দিন মাছ শিকার সরকার নিষিদ্ধ করলেও ভারতের জেলেরা ঠিকই বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। আমরা তো কূলে ফিরে ভাতে মরি। আর সরকারের পক্ষ থেকে যা পাই তা দিয়ে সংসার চালানো মুসকিল। তাও আবার সকল জেলেরা সহায়তা পায় না। ভারত-বাংলাদেশ মিলে যদি সকল অবরোধ দিতে তাহলে সবাই অবরোধ শেষে মাছ শিকার করে ভালো থাকতে পারতাম। কতো লোন-দেনার মধ্যে আছি, সেই টেনশন তো আমাদের মাথায়। অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তার মধ্যদিয়ে দিন পার করতে হবে।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সদস্যরা বলেন, সরকারের সকল নিয়ম-কানুন জেলে এ ট্রলার মালিকরা মেনে চলে। সেইদিকে লক্ষ্য করে অবরোধ আসলেই শুধু ২৫-৩০ কেজি চাল বিতরণ করলেই হবে না। জেলেদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত যে চাল দেয়া হয় এতে তাদের সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে যায়। তাই চালের পাশাপাশি নগদ অর্থও দিতে হবে। অন্যথায় জেলেরা ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মহাসিন বলেন, রবিবার ১৩ অক্টোবর থেকে আগামী ২২ দিন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলের সকল নদীতে মাছ শিকার নিষিদ্ধ। এই ২২ দিনে মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বরগুনার পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর নদীর ৪০টি পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব পয়েন্টে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ মা ইলিশ ধরলে কিংবা মজুদ ও বিক্রি করলে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নিয়ে এসে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নদীতে ও সাগরে পাহারায় থাকবে। নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন।
তিনি আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞার প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে জেলেদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত চাল তাদের হাতে পৌঁছে দেয়া হবে।