• ২৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

একজন দাগি আসামির জেলপরবর্তী জীবন

Mofossal Barta
প্রকাশিত এপ্রিল ৯, ২০২৫, ১৫:৪৫ অপরাহ্ণ
একজন দাগি আসামির জেলপরবর্তী জীবন

‘দাগি’র শেষ ক্লাইম্যাক্সটাও গভীর। আবেগ আর পারিবারিক বন্ধনে যে নাটকীয়তা তৈরি করেছেন নির্মাতা, সেটা নাড়িয়ে দেয়, সিনেমায় ব্যবহার করা শায়েরির মতোই।

সংবাদটি শেয়ার করুন....

বিনোদন ডেস্ক: হাজারটা চাঁদ আসলেও সে রাতের কোনো মূল্য নাই, যদি তুমি না আসো, সেই রাতের কোনো অর্থই নাই।’ শায়েরির এই আবেগ ছুঁয়ে ছিল পুরো সিনেমা। হল থেকে বের হওয়ার পরও সেই আবেগের রেশ রয়ে যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার যাত্রা শেষে সিনেমার পাত্র–পাত্রীরা ততক্ষণে যে হয়ে ওঠে অতি আপন। মফস্‌সল শহরের চেনা সব চরিত্র, জমাটি চিত্রনাট্য, দুর্দান্ত নির্মাণ, মনে রাখার মতো সংলাপ আর বিশ্বাস্য অভিনয় মিলিয়ে ‘দাগি’ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা বাংলা সিনেমা। আফরান নিশো ও শিহাব শাহীনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ বললে বাড়াবাড়ি হবে না।

ট্রেলারে যেমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, গল্পটা তেমনই। এক দাগির প্রায়শ্চিত্তের যাত্রা। প্রেক্ষাপট উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর, সময়কাল চলতি শতকের প্রথম দিক। নিশান (আফরান নিশো) আর জেরিন (তমা মির্জা) এই মফস্‌সল শহরের প্রেমিক যুগল। নিশানের পড়াশোনায় আগ্রহ নেই, অল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার ধান্দায় জড়িয়ে পড়ে চোরাচালানে। যোগাযোগ হয় কলকাতার এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে (শহীদুজ্জামান সেলিম)। জেরিন ভালোভাবে ডিগ্রি পাস করেছে, একের পর এক বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। এর মধ্যে জেরিনকে পছন্দও করে ফেলে এক পাত্রপক্ষ। জেরিন নিশানকে বলে ১৫ তারিখে দেখা করতে, সেদিন কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু, অসাবধানতাবশত এক দুর্ঘটনায় নিশানের হাতে খুন হয় একজন। নিশানের ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়।

সাজা শেষে বাড়িতে ফেরে নিশান। এখন থেকেই শুরু হয় সিনেমা। নিশানের আশা ছিল, আবার নতুন করে জীবন শুরু করবে, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কিন্তু লাল দালানের ছাপ একবার যার গায়ে লেগেছে, চাইলেই কি আর সেই দাগি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, সমাজ কি তাকে মেনে নেয়? সম্পর্ক, আবেগ, সামাজিক বাস্তবতা আর নিশানের মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়ে চলে গল্প।

নিখাদ দেশি গল্প, দেশীয় আমেজে নির্মিত ড্রামা ঘরানার ঢাকাই সিনেমা ইদানীং খুব একটা দেখা যায় না। বড় শহরের স্কাইলাইন থেকে বেরিয়ে মফস্‌সলের প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্য গল্পও তেমন হয় না। তাই ‘দাগি’র জন্য নির্মাতা শিহাব শাহীনের বড় ধন্যবাদ পাওনা। একজন দাগি আসামির জেলপরবর্তী জীবন দেখাতে চেয়েছেন তিনি, পেরেছেনও।
‘দাগি’র সবচেয়ে বড় শক্তি এর চিত্রনাট্য, সংলাপ আর অভিনয়। বর্তমান, ফ্ল্যাশব্যাক, আবার বর্তমান—এই সময়সীমায় নিশানকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে গল্প। যে গল্পের চরিত্রগুলো এতটা চেনা যে তাদের আবেগে মনের অজান্তেই চোখে চলে আসে পানি। ‘দাগি’র চিত্রনাট্য বহুমাত্রিক। প্রায়শ্চিত্তের গল্পের সঙ্গে শিশুদের জন্য ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ বোঝার প্রয়োজনীয়তা, পারিবারিক যৌন হয়রানি, জেন–জি, জেন আলফার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা, সীমান্তবর্তী জেলা শহরে বেকার তরুণদের চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ার টোপও তুলে এনেছেন নির্মাতা।

পর্দায় আলাদা কোনো ‘লেকচার’ ছাড়াই সহজাতভাবে চিত্রনাট্যে ঢুকে গেছে এসব বিষয়। প্রথমার্ধের ড্রামা এতটাই প্রবল যে পর্দা থেকে চোখ সরানো যায় না। বিরতির পর চিত্রনাট্যের জমাটি ভাব একটু ঢিলে হয় বটে, তবে মূল সুর থেকে সরে যায় না। নির্মাতা চেয়েছেন দর্শককে নিশানের পৃথিবীতে নিয়ে যেতে, যেন তার হতাশা, ক্ষোভ, প্রতিশোধপরায়ণতা দর্শককেও স্পর্শ করে, টুকটাক কিছু খামতি থাকলেও সেগুলো যেন চোখে না পড়ে। সে ক্ষেত্রেও তিনি সফল।

সুড়ঙ্গর পর দ্বিতীয় সিনেমায়ও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন আফরান নিশো। ‘নিশান’ চরিত্রের জন্য ওজন বাড়িয়েছেন, ১৪ বছর জেল খেটে অনিশ্চয়তা আর স্বপ্ন নিয়ে বাড়িতে ফেরা যুবকের চরিত্রে তিনি অসাধারণ। শেষ দিকের অ্যাকশন আর শুরুর রোমান্টিক দৃশ্য—দুটোতেই নিজের জাত চিনিয়েছেন নিশো। মনের রাগকে বশ মানাতে বারবার যখন বলতে থাকেন, ‘আল্লার দুনিয়ায় সব সুন্দর, ফুল সুন্দর, পাখি সুন্দর…’ তখন চোখ ফেরানো যায় না। তেমনি জেরিনের সঙ্গে খুনসুটি, বড় এক দুঃসংবাদ পেয়ে রাগে ফুঁসতে থাকা তরুণের চরিত্রে অভিনয়ও ভালো লাগে। সিনেমার মেজাজের সঙ্গে জুড়ে আছে শায়েরি। নিশানের শায়েরি বলা নিশোর গম্ভীর কণ্ঠে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে।

‘জেরিন’ চরিত্রে নিশোকে যোগ্য সংগত দিয়েছেন তমা মির্জা। ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘ফ্রাইডে’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘আমলনামা’ থেকে ‘দাগি’—অভিনেত্রী হিসেবে আরও পরিণত হয়েছেন তমা। প্রথম অংশে বেকার প্রেমিককে নিয়ে ত্যক্তবিরক্ত জেরিন থেকে দ্বিতীয়ার্ধের পরিণত জেরিন হিসেবে তাঁকে মনে রাখতেই হবে। তবে সিনেমার সবচেয়ে বড় চমক সুনেরাহ বিনতে কামাল। কথা বলতে না পারা তরুণী লিখনের চরিত্রে তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন। শুধু অভিব্যক্তি দিয়ে কিছু না বলেও অনেক কথা বলেছে তাঁর চোখ। সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার যে তিনি এমনি পাননি, সেটা প্রমাণ করেছেন সুনেরাহ। অন্তর্জাল-এর গ্ল্যামারাস চরিত্র থেকে ‘দাগি’র ‘লিখন’ হওয়া, সুনেরাহর ক্যারিয়ারে যোগ করেছে নতুন পালক।

গত কয়েক বছর বড় পর্দায় নিয়মিত শহীদুজ্জামান সেলিম। দুর্দান্ত অভিনয় করেন তিনি। কিন্তু অনেক সময়ই তাঁর চরিত্রগুলো একই রকম হয়ে যায়। এবারের ঈদের দুই সিনেমায়ই (বরবাদ ও জংলি) তাঁকে যেমন আইনজীবীর ভূমিকায় দেখা গেছে। তবে ‘দাগি’তে নির্মাতা তাঁকে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতীয় চোরাকারবারির চরিত্র, হিন্দি-বাংলা মেশানো সংলাপ মিলিয়ে খল চরিত্রে তিনি বেশ মানিয়ে গেছেন। একই কথা রাশেদ মামুন অপুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সিনেমা ও সিরিজে খল চরিত্রে তাঁকে দেখা গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগই ক্লিশে। কিন্তু এই সিনেমায় তাঁকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। তাঁর ক্রূর হাসি আর চোরা চাহনি ভয় ধরিয়ে দেয়।

অন্যান্য চরিত্রের পার্শ্ব–অভিনেতারাও ছিলেন খুব ভালো। নিশানের বন্ধু বাবুর চরিত্রে রাজীব সালেহীন, নিশানের বাবার চরিত্রে গাজী রাকায়েত ছিলেন যথাযথ। সন্তানহারা মায়ের চরিত্রে মনিরা আক্তার মিঠুও ভালো করেছেন। তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘মরার সময় পানি পাবি না রে জানোয়ার’, সেই হাহাকার মন ছুঁয়ে যায়। কেবল এই সংলাপই নয়, পুরো সিনেমার অনেক সংলাপই মনে রাখার মতো। ‘এই ১৪টা বছর আমি আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করসি, সবাই যেন আমারে মাফ কইরা দেয়’, ‘ক্ষমা চাইতে অনেক সাহস লাগে। অনেক ক্ষমতাশালীর পতন হইসে ক্ষমা চায় নাই বইলা’—এমন অনেক সংলাপ হল থেকে বের হওয়ার পরও মনে থাকে।
দাগির আবহ সংগীতের কাজ দারুণ। এ জন্য সাজিদ সরকার ও শুভদীপ গুহর বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। ছবির পুরোটা সময় মেজাজ বুঝে দারুণ আবহ সংগীতের ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও কোথাও পুরোপুরি অ্যাম্বিয়েন্ট সাউন্ড রাখা হয়েছে। শুনতে ভালো লাগে রিকশার টুংটাং, হাঁসের দলের ছুটে চলা, মানুষের কোলাহল। ছবির মেজাজ বুঝে ‘নিয়ে যাবে কি’, ‘একটুখানি মন’ গানগুলোর ব্যবহারও হয়েছে যথাযথ।
‘দাগি’র শেষ ক্লাইম্যাক্সটাও গভীর। আবেগ আর পারিবারিক বন্ধনে যে নাটকীয়তা তৈরি করেছেন নির্মাতা, সেটা নাড়িয়ে দেয়, সিনেমায় ব্যবহার করা শায়েরির মতোই।