• ২৪শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কুড়িগ্রামে নদী ভাঙন: বারবার নিঃস্ব নদী তীরবর্তী মানুষ

Mofossal Barta
প্রকাশিত অক্টোবর ২১, ২০২৫, ১৬:৪৪ অপরাহ্ণ
কুড়িগ্রামে নদী ভাঙন: বারবার নিঃস্ব নদী তীরবর্তী মানুষ
সংবাদটি শেয়ার করুন....

 

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫ ইং ০৩:০০ পিএম.

জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে নদী ভাঙন বেড়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হচ্ছে কুড়িগ্রামের নদ-নদী তীরবর্তী জনপদ। নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ এবং নদী শাসনের পাশাপাশি বাঁশের বান্ডল তৈরির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

নদী ভাঙনে জমিজমা হারিয়ে অন্যের জমিতে খুঁটিবিহীন ঘরের চালের মধ্যে বিধবা নাছিমা বেওয়ারের বৃদ্ধা মা, মেয়ে, বোন নিয়ে বসবাস। অন্যের বাড়িতে কাজ করেই চলছে তার সংসার। এ ছাড়া, ভিটেমাটি হারিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরেই থাকার জন্য ছাপড়া আর কাপড় দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকছেন ময়না বেগমের পরিবার। খেয়ে না খেয়ে এভাবেই কেটে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার শৌলমারী ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের শতশত পরিবারের।

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, জিঞ্জিরামসহ নদ-নদীগুলো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। যে সময় নদ-নদীগুলো নিস্তবদ্ধ থাকার কথা সে সময় পানির সমতল হ্রাস-বৃদ্ধিতে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে একের পর এক বসতি, আবাদি জমি আর স্থাপনা। নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার।

সরকারি হিসেবে গত ছয় বছরে জেলায় নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার পরিবার। আর কৃষি জমি বিলিন হয়েছে ১৫৩ হেক্টর। এতে করে কয়েক বছরে জেলার প্রায় সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।

চর শৌলমারী ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের ময়না বেগম বলেন, ‘নদীর ভাঙনে বাইরে ঘেরের বেরা দিয়ে চার পাশ্বে কাপড় পলিথিন দিয়ে নদীর কিনারায় কোনো রকমে আছি। জায়গা জমি থাকলে তো ওখানে যেতাম।’

নাছিমা বেওয়া (৬০) বলেন, ‘নদীর ভাঙনে বাড়ি ভিটা সব গেইছে, একটা ঘর মানুষের জায়গা নিয়ে আছি। টাকা নাই ঘর এখনো তুলতে পারি নাই। আমার শাশুরিসহ ৫ জন সংসারে আছে। টিনের ঘরটি মাটিতে রেখে চকিতে বিছনা করে আছি। ভয় লাগে কখন জানি পোকামাকর কামড়ায়।’

স্থানীয় আলামিন মিয়া (৭০) বলেন, ‘ভাঙনে আমার বাড়িঘর নদীতে চলে গেছে। কোনোরকমে আসবাবপত্র সরাতে পেরেছি। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাবো, সেই চিন্তায় বাঁচি না।’

বকবুল হোসেন (৬০) নামে একজন বলেন, ‘চোখের সামনে বাড়ি নদীতে চলে গেল। কিছুই করার ছিল না। এখন জমি-ঘর কিছুই নাই। বাচ্চা নিয়ে কী করবো, বৃদ্ধ, নারী-শিশুদের থাকা, খাওয়াসহ নেই জীবনের নিরাপত্তা। আল্লাহই জানেন।’

চর শৌলমারী ইউনিয়নের সোনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমিনুর রহমান মমিন বলেন, গত ছয় থেকে সাত মাস ধরে ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত রৌমারী উপজেলার চরশৌলমারী, বন্দবেড় ইউনিয়ন এবং উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের প্রায় এক কিলোমিটার প্রস্থ ও দৈর্ঘ্যে ছয় কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে করে তিন ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কৃষি জমি প্রায় আড়াই হাজার একরের বেশি বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে মানবেতর জীবন যাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। ভাঙনরোধে স্থায়ীভাবে একটি বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।

চর শৌলমারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, উজনের ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তীরবর্তী মানুষ। এখন তারা নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে।

নদী ও পানি বিষয়ক নাগরিক সংগঠনের (রিভারাইন পিপল) মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞরা কয়েক বছর ধরে জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাবে দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে অসময়ে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত ও মেঘ বিস্ফোরণ বা ক্লাউড বাস্ট। নদী ভাঙন রোধে উজানে নদীতে বাধ না থাকা নিশ্চিত করা, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ করে নদীর নাব্যতা নিশ্চিত এবং স্থানীয়ভাবে বাঁশের বান্ডেলিং করে স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া। যাতে স্রোত এসে তীরে না লাগে, মাঝ নদীতে থাকে। এগুলো করতে পারলে আকস্মিক ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মোঃ রাকিবুল হাসান বলেন, জেলায় প্রায় ৫০টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। এরমধ্যে প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে ৩৫টি পয়েন্টে ভাঙন রোধে কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়াও রৌমারী, রাজিবপুর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের বাম তীর রক্ষায় প্রায় ৯১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।